Skip to main content

আলো এবং তার প্রতিসরণ

আমরা আজ পদার্থবিজ্ঞান (Physics) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলবো। আলো — যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ।

Mejbah Ahammad

আমরা আলো এবং তার প্রতিসরণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি। আলো ও প্রতিসরণ বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল, এবং এর পেছনে রয়েছে কয়েকজন বিজ্ঞানীর অসামান্য অবদান। এই আলোচনায় আমরা প্রতিসরণের আবিষ্কার থেকে শুরু করে তার বিস্তারিত বিবরণ ও বিজ্ঞানীদের অবদানের কথাগুলো ধারাবাহিকভাবে বলবো।

১. প্রাচীনকালের আলোর ধারণা:

প্রাচীনকালে গ্রিক দার্শনিকরা আলোর প্রকৃতি নিয়ে ভেবেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিক ইউক্লিড (Euclid) এবং প্লেটো (Plato) মনে করতেন, আমাদের চোখ থেকে একটি আলো বেরিয়ে আসে যা বস্তুর উপর পতিত হয় এবং আমরা তখন সেই বস্তুকে দেখতে পাই। যদিও এটি ভুল ধারণা ছিল, কিন্তু তারা আলোর প্রতিসরণের মূল ধারণা সম্পর্কে কিছুটা অবগত ছিলেন।

২. ইবনে আল-হাইথমের (Ibn al-Haytham) গবেষণা:

আলো নিয়ে গঠনমূলক গবেষণা শুরু হয় মধ্যযুগে, যখন ইবনে আল-হাইথম (Ibn al-Haytham), যিনি "আল-হাজেন" নামে পরিচিত ছিলেন, আলোর প্রতিসরণ এবং প্রতিফলন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি ১০২১ সালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "কিতাব আল-মানাজির" (Book of Optics) লিখেছিলেন, যেখানে তিনি আলোর চলাচল, প্রতিসরণ এবং প্রতিফলন বিষয়ে বিশদ গবেষণা করেন। তিনি প্রথম প্রমাণ করেন যে, আলো চোখ থেকে বেরিয়ে আসে না, বরং বাহ্যিক উৎস থেকে চোখে প্রবেশ করে।

ইবনে আল-হাইথমের (Ibn al-Haytham)

৩. স্নেলের (Snell) অবদান এবং প্রতিসরণের সূত্র:

১৬২১ সালে, ডাচ গণিতবিদ উইলব্রোর্ড স্নেল (Willebrord Snellius) প্রতিসরণের সূত্র আবিষ্কার করেন, যা আজকে আমরা স্নেলের সূত্র (Snell's Law) নামে চিনি। এই সূত্রটি বলে, যখন আলো এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করে, তখন তার গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং প্রতিসরণ কোণ গাণিতিকভাবে নির্ধারণ করা যায়। তার গবেষণা আমাদেরকে আলোর প্রতিসরণ বোঝার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দেয়।

উইলব্রোর্ড স্নেল (Willebrord Snellius)

৪. আইজ্যাক নিউটনের (Isaac Newton) আলো নিয়ে গবেষণা:

আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton) ১৬৬৬ সালে তাঁর আলো নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা চালান। তিনি প্রিজমের সাহায্যে আলোকে বিভিন্ন রঙে বিভক্ত করেন এবং প্রমাণ করেন যে আলো আসলে বিভিন্ন রঙের সমন্বয়ে গঠিত। যদিও নিউটন আলোর কণিকা তত্ত্ব (Corpuscular Theory of Light) প্রচার করেছিলেন, যা বলে যে আলো ছোট ছোট কণিকাগুলোর সমন্বয়ে তৈরি, পরবর্তী সময়ে এই তত্ত্ব আলোর তরঙ্গ প্রকৃতির মাধ্যমে পরিমার্জিত হয়।

আইজ্যাক নিউটন (Isaac Newton)

৫. থমাস ইয়ং (Thomas Young) এবং তরঙ্গ তত্ত্ব:

১৮০১ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং (Thomas Young) তার ডবল স্লিট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, আলো তরঙ্গের মত আচরণ করে। তিনি দেখান, যখন দুটি আলোর রশ্মি একে অপরের সাথে মিশে, তখন তারা "ইন্টারফেরেন্স" তৈরি করে, যা তরঙ্গের গুণ। এর ফলে আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলন বিষয়ে আমাদের বোঝা আরও পরিষ্কার হয়।

থমাস ইয়ং (Thomas Young)

৬. জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell):

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ১৮৬৫ সালে আলোর বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকীয় প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে তার বিখ্যাত বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় তরঙ্গ তত্ত্ব (Electromagnetic Wave Theory) প্রকাশ করেন। তিনি দেখান, আলো একটি বৈদ্যুতিক-চৌম্বকীয় তরঙ্গ যা শূন্যস্থানে ছড়াতে পারে এবং এই তরঙ্গের গতি প্রতিসরণের জন্য দায়ী।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell)

৭. আধুনিক যুগের আলো ও প্রতিসরণ:

আধুনিক যুগে, আমরা আলোর প্রতিসরণের তত্ত্ব আরও গভীরভাবে বুঝেছি এবং তা বিভিন্ন প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করেছি। উদাহরণস্বরূপ, ফাইবার অপটিক্স (Fiber Optics) প্রযুক্তিতে আলোর প্রতিসরণের ব্যবহার এক উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। আমাদের দৈনন্দিন ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় এই প্রযুক্তির অবদান অপরিসীম।

আমরা এখন জানি যে, আলোর প্রতিসরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার ভিত্তি রয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর ধারাবাহিক গবেষণায়। ইবনে আল-হাইথম, স্নেল, আইজ্যাক নিউটন, থমাস ইয়ং, এবং জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল সহ আরও অনেক বিজ্ঞানীর অবদান আমাদের আজকের আলো বিষয়ক জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। আপনাদের যদি প্রতিসরণের ওপর আরও গবেষণা করার ইচ্ছা থাকে, তবে বিজ্ঞানের এই অসীম জগতে প্রবেশ করে আমরা সবাই একসাথে নতুন আবিষ্কারের দিকে ধাবিত হতে পারি।